রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ অপরাহ্ন
মুঘল আমলে পুরান ঢাকার রমজানের মধ্য রাতে সুরেলা কন্ঠ দিয়ে একদল তরুণ রোজাদারদের ঘুম থেকে তোলার ‘মহান’ দায়িত্ব পালন করত। ঢাকঢোল পিটিয়ে দলবেঁধে রমজান মাসের স্তুতির পাশাপাশি পাড়ার লোকদের জানিয়ে দিত সেহরীর সময় হয়েছে, ঘুম থেকে উঠতে হবে।
ফারসি ও উর্দু ভাষার এসব গীত কালের বিবর্তনে বাংলার রূপ পরিগ্রহ করে বিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় হারিয়ে গেছে। যদিও আজো পুরান ঢাকায় রমজান আসলে ভোররাতে এমন হাকডাক শুনা যায় কিন্তু তা নেহাত ঐতিহ্যের ধারা রক্ষার্থে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের ঘুম ভাঙে এখন মুঠোফোনের এলার্মের শব্দে, আর প্রয়োজন পড়েনা এসব সওয়াব অর্জনের ব্রত নিয়ে ঘুম থেকে তোলা তরুণের দলকে। সেহরীর পূর্বে উর্দু ফার্সি ভাষায় রোজাদারদের জাগিয়ে তোলার এ পদ্ধতির নাম কাসিদা।
কাসিদা কি?
কাসিদা একটি ফার্সি শব্দ। এর মূল অর্থ হচ্ছে কবিতার ছন্দে প্রিয়জনদের প্রশংসা করা। কাসিদা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে আরবি ক্বাসাদ থেকে। ক্বাসাদ শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ । ক্বাসাদ বিবর্তিত হয়ে ফারসি কাসিদায় রূপান্তরিত হয়েছে । সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে কবিতায় প্রিয়জনের প্রশংসা করা হয় তাকে কাসিদা বলে। ইবনে কুতাইলা রচিত নবম শতকের বই আন-শিরা ওয়া আন শুয়ারা’য় কাসিদার গঠনতন্ত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
এ গ্রন্থ অনুযায়ী কাসিদার রয়েছে তিনটি অংশ। প্রথম অংশকে বলা হয় নসিব, যেখানে স্মৃতিকাতরতা প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় তাখাল্লাস, যেখানে জীবনযাত্রার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হয়। আর তৃতীয় অংশকে বলা হত হিজা, যেখানে মূলত অন্যের প্রতি ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করা হত। কাসিদা বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। দর্শনতত্ত্ব, প্রশস্তিমূলক, ভক্তিমূলক, রমজান ও ইদের কাসিদা।
বাংলাদেশে কাসিদা
বাংলাদেশে কাসিদার প্রচলন মুঘলদের হাত ধরে। ১৬০৮ সালে সুবাদার ইসলাম খানের সাথে মুঘল সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঢাকায় কাসিদার বিকাশ ঘটে। রাজবন্দনা, আল্লাহ-নবীর সিফত, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হত এসব কাসিদায়। ঊনিশ শতকের পর থেকে রোজার মাসে কাসিদা পাঠের ধুম পড়ে যায় ঢাকার অলিতে গলিতে।
প্রথম প্রথম ফার্সি ও উর্দুতে হলেও পরে ঢাকার স্থানীয় হিন্দুস্তানি ভাষায় কাসিদার চর্চা হতে থাকে। বিশ শতকের সেই জমজমাট কাসিদার আসর কিংবা কাসিদাওয়ালাদের হাকডাক আজ ঐতিহ্যের ইটের গাঁথুনিতে বিলীনপ্রায় যদিও তবুও রমজানের রাতে আজো পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে সেই পুরনো সংস্কৃতির কিঞ্চিত চর্চা লক্ষ্য করা যায়।
রমজানের কাসিদা
ঢাকার কাসিদা চর্চা বলতে প্রধানত রমজানের কাসিদাকেই নির্দেশ করে। তিনটি পর্বে বিভক্ত ছিল রমজানের কাসিদা। প্রথম পর্বকে বলা হত চাঁন রাতি আমাদ। এই পর্বে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে সেহরির জন্য ঘুম থেকে বাসিন্দাদের তুলত কাসিদাওয়ালারা। দ্বিতীয় পর্বকে বলা হত খোশ আমদেদ। রমজানে মধ্যভাগ পর্যন্ত তার গুরুত্ব উল্লেখ করা হত এ কাসিদায়। তৃতীয় পর্বকে বলা হত আল-বিদা। রমজানকে বিদায় জানিয়ে কাসিদাওয়ালারা সুমধুর আবেগঘন কন্ঠে ঘুম থেকে জাগাতো মানুষদের। এছাড়া কাসিদার আসর বসতো একটি বিশেষ জায়গায়।
যেহেতু হযরত আলী রমজানের ১৯ তারিখ খঞ্জরবিদ্ধ হোন এবং ২১ তারিখ মারা যান সেহেতু বিদায়ি কাসিদায় এই বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলা হত এবং সে অনুযায়ী শোকগাথা পরিবেশিত হত। রমজানের শেষদিকে পুরান ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় কাসিদার আসর বসত, প্রতিযোগিতা হত এ পাড়া-ও পাড়ার কাসিদাওয়ালার মাঝে। প্রত্যেক পাড়ার নিজস্ব দলের কাছে ছিল পাড়ার মানমর্যাদার দায়িত্ব। পুরান ঢাকার উর্দু রোড ছিল কাসিদার মূল আসরকেন্দ্র। এছাড়া হোসনি দালান, বংশীবাজারেও নিয়মিত কাসিদার আসর বসত। সেহরির সময়ে যখন কাসিদাওয়ালারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাক দিত তখন জনপ্রিয় সব সিনেমার গানের অনুকরণে এসব কাসিদাকে মনে হত এক অপার্থিব সংগীতের দ্যোতনা। রমজানের বিদায়ী কিছু কাসিদার উল্লেখের লোভ সামলাতে পারছি না।
ঊনিশ শতকের শেষ নাগাদ শুরু হওয়া কাসিদা পুরান ঢাকার সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছিল বেশ ভালভাবেই। রমজান আসলেই ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় কাসিদা প্রতিযোগিতার ধুম পড়তো। গঠন করা হত স্বেচ্ছাসেবক যারা কিনা সেহরিতে গীত গেয়ে পাড়ার লোকদের ঘুম ভাঙানোর পবিত্র দায়িত্ব পালন করত। উঠতি বয়সী এসব তরুণ আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে কিন্তু পুরান ঢাকার অলিগলিতে রেখে গেছে সেই পুরনো ছাপ। তাই আজো স্বল্প পরিসরে হয় কাসিদা প্রতিযোগিতা, ঐতিহ্যিক ধারা রক্ষার সাথে তারা মনে করিয়ে দেয় সেই সেকেলে জীবনের যাপিত কর্মের কথা।